ষষ্ঠ শ্রেণি (মাধ্যমিক) -
বিজ্ঞান -
বিজ্ঞান অনুশীলন বই |
| NCTB BOOK
1
প্রথম সেশন
আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।
রবিঠাকুরের লেখা উপরের কবিতার লাইনগুলো পড়ো নি এমন কেউ তো নেই নিশ্চয়ই! সত্যি বলতে নদী নিয়ে লিখেন নি বাংলাদেশের এমন কোনো কবি আছেন কি না সন্দেহ। নদী নিয়ে কবিতা, সাহিত্যের যেমন সীমা নেই, তেমনি অন্ত নেই গানেরও। এদেশের মানুষের আনন্দ, বেদনা, উৎসব সবকিছুর সঙ্গেই নদীর যোগ রয়েছে; সাহিত্যে, গানে, ছবিতে তাই নদীর প্রসঙ্গ আসবেই। আর আমাদের নদীর নামগুলোও কী চমৎকার পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, কুশিয়ারা, ধলেশ্বরী, ব্রহ্মপুত্র, কীর্তনখোলা, করতোয়া, তুরাগ, এমন আরও কত কত নাম! নদী নিয়ে বিখ্যাত অনেক গান বা কবিতার কথা নিশ্চয়ই তোমাদেরও জানা? ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে যাও, তারপর একটু দলের বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করে দেখো তোমাদের কার কোন কবিতা বা গান প্রিয়। চাইলে ক্লাসে সব দল থেকে একজন করে একটা ছড়া/ কবিতা / গান আবৃত্তি করে বা গেয়ে অন্যদেরকে শোনাতে পারো।
এবার একটু ভেবে দেখো, তোমাদের এলাকার সবচেয়ে কাছে কোন নদী আছে? তোমার গ্রাম বা শহরের একেবারে কাছেই কোনো নদী না থাকলেও বিল, হাওর, বাঁওড় নিশ্চয়ই আছে! তোমরা কখনো দেখতে গেছ? এখন তোমার নদীকে (কিংবা বিল / হাওর / বাঁওড় যা-ই হোক না কেন) এঁকে দেখাও তো নিচের ফাঁকা জায়গায়
(কেউ যদি চাও ছবির বদলে কয়েক লাইন কবিতাও লিখে ফেলতে পারো। যার যেটা ভালো লাগে!)
উপরের ছবিতে বাংলাদেশের অনেকগুলো নদীর নাম, দেখতে পাচ্ছ? যাদুকাটা, কর্ণফুলী, কুশিয়ারা, সোমেশ্বরী, দুধকুমার, ভুবনেশ্বর, আন্ধারমানিক— কী চমৎকার সব নাম, তাই না?
ছবির নদীগুলোর মধ্যে কোন কোন নদীর নাম তুমি আগেই শুনেছ? তোমার বন্ধুদের সাথে আলাপ করে দেখো তো, কে কয়টা নদীর নাম আগে থেকেই জানত?
তোমরা কি জানো, বাংলাদেশে কয়েক বছর আগে একটা দারুণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে? সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নদীকে জীবন্ত সত্তার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এর মানে মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীর যেমন মৌলিক অধিকার আছে, তেমনি নদীরও আছে। কেউ কোনো মানুষের ক্ষতি করলে যেমন আদালতে বিচার হয়, নদীর ক্ষতি করলেও তা-ই হবে! একটু ভেবে দেখো তো, নদীকে এভাবে জীবন্ত প্রাণীর সঙ্গে তুলনা করার কারণ কী হতে পারে? তোমার দলের অন্যদের সঙ্গে আলাপ করে নিচে তোমার চিন্তা লিখে রাখো-
তোমার উত্তরের সঙ্গে অন্যদের উত্তর মিলিয়ে দেখো। শিক্ষকসহ সবার সঙ্গে আলোচনায় যোগ দাও। পরের কাজগুলো করতে গিয়ে যদি তোমার চিন্তায় নতুন কিছু যোগ হয়, সেটা পরে খাতায় নোট করে রেখো।
নদী নিয়ে একটা মজার বিষয় হলো- আমরা কেউই কখনো একই নদী একবারের বেশি দেখি না। কথাটা শুনতে আশ্চর্য লাগতে পারে। কিন্তু ভেবে দেখো, নদী দেখতে স্থির মনে হলেও তা কিন্তু সদা প্রবহমান। প্রতি মুহূর্তে নদীর যে ঢেউ দেখছ, তা কিন্তু এক মুহূর্ত আগেও ওখানে ছিল না। কোনো এক পর্বতের গায়ে হয়তো তার কিংবা তার পূর্বপুরুষের জন্ম, বছরের পর বছর ধরে পানি বয়ে নিয়ে চলেছে সাগরে। বাংলাদেশের একটা বড় নদ ব্রহ্মপুত্রের কথাই ধরা যাক। তিব্বতে হিমালয় পর্বতে এই নদের জন্ম, সেই দূর হিমালয় থেকে ভারত হয়ে বাংলাদেশের বুক চিরে মেঘনা নদীতে গিয়ে মিশেছে এই ব্রহ্মপুত্র। এই যে পৃথিবীতে কত শত নদী, প্রতিটির এমন একটা জন্ম ইতিহাস আছে। জন্ম থাকলে কি নদীর মৃত্যুও থাকতে পারে? ভেবে দেখো।
এবার আরেকটা প্রসঙ্গে আসা যাক। নদীকে শুধু যে রূপক অর্থে জীবন্ত সত্তা ভাবা হয় তাই নয়, নদীর উপর অসংখ্য জীবের বেঁচে থাকা নির্ভর করে। মানুষের কথাই যদি বলো, প্রাচীনকালে সমস্ত সভ্যতার শুরুটা হয়েছে কোনো না কোনো নদীর পাড় ঘেঁষে। এখনো পৃথিবীর অনেক জায়গায় মানুষের জীবন ও জীবিকা মূলত নদীকে কেন্দ্র করে। এ তো গেল মানুষের কথা, মানুষ ছাড়াও অন্য অনেক জীবের জীবন পরিচালিত হয় নদী ও নদীর আশপাশের পরিবেশের উপর ভিত্তি করে। এই বিষয়টা তোমরা নিজেরাই অনুসন্ধান করে দেখতে পারো। তবে সেজন্য তোমার নিজের নদীকে আরেকটু জানতে হবে, শুধু নদীকেই নয়, নদীকে ঘিরে যেসকল জীবন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে সেগুলোকেও।
যদিও এই অনুসন্ধানের বর্ণনা দিতে গিয়ে আমরা শুধু নদীর কথাই বলব, তবে যাদের খুব কাছে কোনো নদী নেই, তাদেরও চিন্তার কিছু নেই। সবচেয়ে কাছাকাছি যে বিল, হাওর, বাঁওড়, কিংবা নিদেনপক্ষে পুকুর আছে সেখানেও তোমরা একইভাবে অনুসন্ধান করতে পারো।
পরের সেশনের আগে তোমাদের কাজ হলো দলের সবাই মিলে নদী পর্যবেক্ষণ করা, সে জন্য একদিন ঘুরতে যেতে পারো দলের সবাই মিলে। কাজের সুবিধার জন্য কে কোন ধরনের তথ্য খুঁজে নিয়ে আসবে তার ওপর ভিত্তি করে দলের সকলে মিলে কাজ ভাগ করেও নিতে পারো।
পর্যবেক্ষণ করে যেসব তথ্য তোমরা আনতে পারো তা এরকম-
নদীর গল্প
(নদীটা কত বড়? কত পুরোনো? এই নদীর ইতিহাস কিংবা নদীটা সম্পর্কে বিশেষ কোনো তথ্য বা গল্প যদি থাকে তাও খুঁজে দেখতে পারো। এই তথ্যের জন্য তোমরা এলাকার স্থানীয় মানুষদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো। এলাকার যারা বয়স্ক তারা হয়তো ভালো বলতে পারবেন। তোমাদের শিক্ষকদেরকেও জিজ্ঞেস করতে পারো।)
নদীতে এবং নদীর তীর ঘেঁষে কী ধরনের জীবের দেখা মেলে?
(এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য তোমাদের নদীর আশপাশের এলাকাটা খুঁটিয়ে দেখতে হবে। কী ধরনের উদ্ভিদ জন্মে, কী ধরনের পোকামাকড়, পশু বা পাখি দেখা যায় সে সম্পর্কে তথ্য লাগবে। আবার নদীতে কী ধরনের মাছ পাওয়া যায়, মাছ ছাড়া অন্য কী ধরনের জলচর জীব নদীতে বাস করে সে তথ্যও জোগাড় করতে পারলে ভালো। এত সব তথ্য হয়তো নিজে খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে, সেক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে আশেপাশের মানুষজনের সাহায্য নিতে পারো।
সময়ের সঙ্গে নদীতে এবং নদীর আশেপাশের পরিবেশে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে?
(তোমাদের নদীতে আগে কী কী মাছ পাওয়া যেত যেগুলো এখন আর দেখা যায়না? কিংবা এমন কোনো উদ্ভিদ বা প্রাণীর কথা শুনেছ, যারা নদীর আশপাশেই বাস করত কিন্তু এখন আর নেই? এর আগে তোমরা হারিয়ে গেছে যারা শিখন অভিজ্ঞতায় তোমাদের আশেপাশের হারিয়ে যাওয়া বিলুপ্ত জীবের খোঁজ করেছ। এবার নদীতে বা নদীর আশপাশে যেসব জীব বিলুপ্ত হয়েছে সে বিষয়েও তথ্য নিয়ে আসতে পারো। কিংবা নদীর অন্য কোনো পরিবর্তনের কথাও আসতে পারে যেমন ধরো, আগে যে নদী খরস্রোতা ছিল, এখন তা হয়তো শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে গেছে; এটাও তো একটা বড় পরিবর্তন। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এলাকার বয়স্ক মানুষেরা তোমাদের সাহায্য করতে পারবেন।)
দ্বিতীয় সেশন
নিশ্চয়ই সবাই এর মধ্যে নদী নিয়ে অনেক তথ্য পেয়েছ? দলের সবাই আলোচনা করে নিচের ছকে নোট নাও-
এবার একটু ভেবে দেখো, এই যে কোনো না কোনো জীব হারিয়ে গেছে, কিংবা নদী ও নদীর আশপাশের পরিবেশে সময়ের সঙ্গে যে পরিবর্তন হচ্ছে, এর কারণ কী? তোমরা কি ভেবে বের করতে পারো এর পেছনে প্রাকৃতিক কী কী কারণ থাকতে পারে? মানুষের নানা কর্মকাণ্ডের কী কী প্রভাব থাকতে পারে সেটাও চিন্তা করো। দলের সবাই নিজেদের মধ্যে আলাপ করে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলো খাতায় টুকে রাখো। লেখা শেষ হয়ে গেলে অন্য দলগুলোর সঙ্গে আলাপ করে দেখো তারা কী কী কারণের কথা লিখেছে।
আরেকটু গভীরে চিন্তা করার জন্য এবার একটা বা দুটো পরিবর্তনকে বেছে নাও, এই পরিবর্তনের পেছনে যত রকম কারণ দায়ী, দেখো তো সেগুলোকে একটা ছাঁচে ফেলা যায় কিনা। যে কারণগুলোর কথা তোমরা বলছ তার ফলে আসলে পরিবেশের কোন কোন উপাদান সরাসরি প্রভাবিত হয়?
একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে, ধরো কোনো নদীতে হয়তো একটা সময়ে শুশুক দেখা যেত, এখন আর নেই। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে হয়তো দেখা গেল, একটা সময়ে মানুষ প্রচুর শুশুক শিকার করেছে, ফলে তাদের সংখ্যা কমতে কমতে এই এলাকা থেকে একেবারে হারিয়েই গেছে। এই ক্ষেত্রে সরাসরি মানুষের কারণে নদীর পরিবেশের একটা বড় উপাদান যে জীবভাগ, তাতে পরিবর্তন এসেছে। আবার এমনও হতে পারে যে, কোনো কারণে (যেমন ধরো কলকারখানার বর্জ্যোর ফলে ) পানি দূষিত হয়ে এমন অবস্থা যে শুশুকের মতো প্রাণী আর টিকতে না পেরে হারিয়ে গেছে। এই ক্ষেত্রে মানুষ সরাসরি শুশুক শিকার না করলে কী হবে, ঘুরেফিরে মানুষের কারণেই পরিবেশের আরেকটা বড় উপাদান (পানি) দূষিত হয়েছে এবং তার প্রভাব জীবজগতে পড়ছে।
অন্য আরেকটা উদাহরণ দিই এবার। ধরা যাক, এককালের কোনো এক খরস্রোতা নদী এখন শুকিয়ে নালার মতো হয়ে গেছে। এর কারণ কী? হয়তো নদীর নিচে পলি পড়ে গভীরতা অনেক কমে গেছে, পানির প্রবাহও কমে গেছে, ফলে নদীর আগের জৌলুশ গেছে হারিয়ে! এই ক্ষেত্রে কারণটা কিন্তু পুরোপুরি প্রাকৃতিক।
পরিবেশের উপাদানগুলো সম্পর্কে আরেকটু জেনে নিলে তোমাদের কাজটা আরও সহজ হবে। দলে বসে তোমাদের বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ বইয়ের পঞ্চদশ অধ্যায় পরিবেশ ও ভূমিরূপ' থেকে পরিবেশ ও পরিবেশের মূল যে চারটি উপাদান তা সম্পর্কে ভালো করে পড়ে নাও।
পড়া হয়ে গেলে আবার আগের প্রশ্নে ফিরে যাই চলো। তোমাদের নদী ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় জীববৈচিত্র্যের পরিবর্তনের যেসব কারণ তোমরা খুঁজে বের করেছ, সেগুলোকে পরের পৃষ্ঠার ছকে সাজিয়ে নাও-
এবার আমাদের দেখার চোখটাকে একটু বড় করা যাক, কী বলো? এতক্ষণ তো আমরা শুধু বাড়ির কাছের নদী নিয়েই আলাপ করছিলাম, নিজের নদীর ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করছিলাম। এবার যদি গোটা বাংলাদেশকে বিবেচনায় নিই তাহলে আগে বোঝা দরকার কেন বাংলাদেশের পরিবেশের অনেকখানিই নদীর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কিত। পাশের পৃষ্ঠায় বাংলাদেশের নদীর মানচিত্রটা দেখো, বুঝতেই পারছ কত অসংখ্য নদী এই দেশের বুক চিরে বয়ে চলেছে। নদীই এই দেশের প্রাণ বললে খুব একটা ভুল বলা হয় না।
তুমি কি তোমার গ্রাম / শহর কোথায় আন্দাজ করতে পারো নিচের মানচিত্র থেকে? চাইলে শিক্ষকের সাহায্য নিয়ে আনুমানিক জায়গাটায় একটা ছোট চিহ্ন দিয়ে রাখতে পারো। এবার মানচিত্রে তোমার সবচেয়ে কাছের নদী খুঁজে বের করো। তার জন্ম কোথায়, আর কোথায় গিয়ে মিশেছে লক্ষ করে দেখো তো!
এবার একটা মজার খেলা খেললে কেমন হয়? মানচিত্রে দেওয়া সবগুলো নদীর নাম চিরকুটে লিখে ভাঁজ করে লটারি করতে হবে। যার হাতে যে নদীর নাম উঠবে তাকে সেই নদীটি মানচিত্রে খুঁজে বের করতে হবে। তোমার দলের কে সবচেয়ে অল্প সময়ে সবচেয়ে বেশি নদী খুঁজে বের করতে পারে দেখা যাক!
তৃতীয় ও চতুর্থ সেশন
বুঝতেই পারছ, আমাদের দেশটা বলতে গেলে পুরোটাই নদীবিধৌত। এটা বাংলাদেশের জন্য এক ধরনের আশীর্বাদ বলতে পারো, পৃথিবীর বহু দেশে এর অর্ধেক সংখ্যক নদীও নেই। নদীর জীবন বুঝতে গেলে শুধু নদী বুঝলে হবে না, স্থলভূমির বৈশিষ্ট্যগুলোও জানতে হবে। কারণ তোমরা তো ইতোমধ্যেই জেনেছ যে, পরিবেশের সবগুলো উপাদান একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত; এবং প্রতিটি উপাদান একে অপরকে প্রভাবিত করে।
দলে বসে একই অধ্যায় থেকে ভূমিরূপের ধারণা নেওয়ার পর বাংলাদেশের ভূমিরূপ সম্পর্কে একটু জেনে নাও। বাংলাদেশের প্রধান কয় ধরনের ভূমিরূপ এবং এই ভূমিরূপ কীভাবে তৈরি হয়েছে, কীভাবে পরিবর্তিত হয় সেগুলো পড়ে নিজেরা আলোচনা করো। এবার 'বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিক বৈচিত্র' অংশটা পড়ে আবার দলে আলোচনা করো, এ অঞ্চলের প্রকৃতি সম্পর্কে একটা সামগ্রিক ধারণাও তাহলে তৈরি হবে।
পড়া হয়ে গেছে? একটা বিষয় লক্ষ করেছ? আমরা খুব সংগত কারণেই বন্যাকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে বিবেচনা করি, বন্যাকে ভয় পাই। ভয় পাওয়া অস্বাভাবিক না, কারণ বহু মানুষের বহু দুর্ভোগের কারণ এই বন্যা। কিন্তু খেয়াল করে দেখো, এই দেশের ভূমির শতকরা আশি ভাগ (৮০%) বন্যার সময়ে বয়ে আসা পলিমাটি দিয়ে তৈরি। তারমানে, বন্যাও খুব স্বাভাবিক একটা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, এবং প্রাচীনকাল থেকে মানুষসহ সকল জীবজগৎ এর সঙ্গে খাপ খাইয়েই বেঁচে আছে। বিপদ ঘটে যখন বিভিন্ন কারণে এই সিস্টেমে হঠাৎ কোনো পরিবর্তন আসে, যার সঙ্গে পরিবেশের উপাদানগুলো খাপ খাওয়াতে পারে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- নদীর বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ দেওয়ার কারণে অসময়ের বন্যা ঘটার নজির যেমন আছে, নদী শুকিয়ে মারা যাওয়ার ঘটনাও আছে অনেক।
প্রকৃতির এই সিস্টেমের সাম্যাবস্থা বজায় রাখতে তাই প্রত্যেকের যার যার ভূমিকা পালন করা জরুরি। পরিবেশ সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা সম্পর্কে ধারণাগুলো আরেকটু স্পষ্ট করতে এই নামে তোমাদের বিজ্ঞান বইয়ে যে অধ্যায়টি আছে তা তোমরা আগেই পড়েছ, আবার দলের সবাই মিলে একটু চোখ বুলিয়ে নাও। মানবসৃষ্ট কারণে স্থানীয় প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিবর্তন সম্পর্কে যা লেখা আছে, তার সঙ্গে কি তোমাদের প্রাপ্ত তথ্যের কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছ?
তোমাদের দলের খুঁজে আনা তথ্যগুলোর দিকে এখন আরেকবার তাকাও। তোমাদের নদীকে ভালোভাবে বাঁচিয়ে রাখতে কী করা উচিত তা নিয়ে নিশ্চয়ই ভাবনা হচ্ছে এখন? তবে গত কয়েকটা সেশনে নিশ্চয়ই এও বুঝতে পারছ যে, সবাই মিলে চেষ্টা না করলে নদীকে বাঁচানো খুব কঠিন। কাজেই এই বিষয়ে শুধু তোমাদের ক্লাসে নয়, বরং ক্লাসের বাইরেও সবাইকে বোঝানোর জন্য কিছু একটা করা জরুরি। এর শুরুটা তোমাদের স্কুল থেকেই কিন্তু হতে পারে!
তবে তার আগে ঠিক করা জরুরি যে, তোমার নদীর পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে তুমি যেসব তথ্য পেয়েছ, তার ভিত্তিতে তোমাদের এলাকার মানুষের করণীয় আসলে কী হওয়া উচিত। প্রাকৃতিক কারণগুলো নিয়ে হয়তো খুব বেশি কিছু করতে পারবে না, কিন্তু মানবসৃষ্ট যেসব কারণে তোমাদের নদীর পরিবেশ আক্রান্ত হচ্ছে সেগুলোকে অন্তত কমিয়ে আনা যায় কীভাবে সেটা ভেবে দেখো।
দলে আলাপ করে তোমাদের মাথায় যা যা সমাধান আসে তা পরের পৃষ্ঠায় লিখে রাখো-
এই সমাধানগুলো বাস্তবায়নে দুই রকম কাজ তোমরা করতে পারো,
১। তোমাদের নদী ও নদীকে ঘিরে কতরকম জীবন বয়ে চলে সেই তথ্য তো তোমাদের কাছে আছেই। তার ভিত্তিতে তোমাদের নদীর বাস্তুসংস্থানের একটা মডেল বানিয়ে সবাইকে দেখাতে পারো। এতে সবার বোধোদয় হতে পারে যে আপাত স্থির এই নদী আসলে কত রকম জীবকে বাঁচিয়ে রেখেছে। মাটি দিয়ে, শোলা কেটে, বা গামলা দিয়ে নদীর কাঠামো দেখিয়ে তাতে সত্যিকারের পানি ব্যবহার করে মডেল বানাতে পারো, কিংবা এর বাইরেও তোমাদের নিজেদের আইডিয়া থেকে অন্য যেকোনো উপকরণ ব্যবহার করতে পারো। বিভিন্ন জীব বোঝাতে কাগজে এঁকে, রং করে কাঠি দিয়ে তোমাদের মডেলে আটকে দিতে পারো। তোমরাই ভেবে সিদ্ধান্ত নাও কীভাবে করবে। সেশনের বাইরেই এই কাজের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পারলে অনেক সময় বেঁচে যাবে।
২। নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং এর আশপাশের প্রকৃতিকে সংরক্ষণ করতে কিছু পরিকল্পনা করে সবাইকে সেটা বোঝানো জন্য কোনো ধরনের প্রচারণা চালাতে পারো। এর শিরোনাম দিতে পারো 'নদী বাঁচাও' (কিংবা তোমাদের পছন্দের অন্য যেকোনো শিরোনাম), হতে পারে সেটা কোনো নাটক বা পোস্টার বা লিফলেট বা ছবির প্রদর্শনী। তোমাদের দল থেকে তোমরা কী কী করতে চাও তা নিজেরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নাও। কী কী উপকরণ লাগবে তা-ও ঠিক করে নাও যাতে পরের সেশনেই এই পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে পারো।
পঞ্চম সেশন
নিশ্চয়ই সব দলের প্রস্তুতি নেওয়া শেষ? এখন ক্লাসে সবাই মিলে আলোচনা করে নাও কীভাবে সব দলের কাজগুলো প্রদর্শিত হবে। সবার বানানো বাস্তুসংস্থানের মডেল ক্লাসের বাইরে বেঞ্চে সাজিয়ে রাখতে পারো যাতে অন্য ক্লাসের শিক্ষার্থীরাও দেখতে পায়। আর 'নদী বাঁচাও' শিরোনামে বিভিন্ন দল যা যা পরিকল্পনা করেছে সেগুলো কীভাবে অন্যদের দেখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে তা শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করে নাও।
পুরো শিখন অভিজ্ঞতা শেষে তোমার দলের সহপাঠীদের কাজ সম্পর্কে তোমার মতামতের জন্য বইয়ের শেষের ছক-৩ পূরণ করো।
পরিশিষ্ট
দাও তোমার মতামত
শিক্ষার্থীরা, তোমরা তোমাদের স্কুলে এবং স্কুলের বাইরে প্রতিদিন বিভিন্ন সময়ে তোমাদের সহপাঠীদের সাথে মিলে অনেক অনেক কাজ করো। যেমন খেলাধুলা, লেখাপড়া বা কোনো এডভেঞ্চার। কেমন হয় যদি তোমার সহপাঠীরা কে কেমন করে বিভিন্ন কাজে অংশ নেয় তার উপর তোমার মতামত নেয়া হয়? মতামত কীভাবে দেবে তার সূত্রটি নিচের দুটি ছকে (১.১ ও ১.২) দিয়ে দেয়া হলো। এটি ব্যবহার করে তুমি ছক-৩ এ মতামত দেবে। ছক-২ কোথায় গেল এটা এখন তোমাদের জন্য রহস্য হয়ে থাকুক। আরেকটু বড় হতে হতে তোমরা নিজেরাই আবিষ্কার করে ফেলবে।
ছক-১: দলে বা জোড়ায় কাজে তোমার সহপাঠী
১.১: দলে বা জোড়ায় কাজে তোমার সহপাঠী যা করে
ছক-৩ পূরণ করা খুব সোজা।
প্রথমে যার ব্যাপারে মতামত দিতে চাও তার রোল নম্বর লিখ। তারপর যে তারিখের কাজের জন্য মতামত দিতে চাও তা লিখ। এবার তার কাজ গুলি দেখো বা মনে করো। উপরে ১.১ ছক পড়ে দেখো, জোড়ায় বা দলের কাজে কার ভূমিকা কেমন ছিল তা বোঝার জন্য কয়েকটি বিকল্প 'ক', 'খ', 'গ', 'ঘ', এবং 'গু' দেয়া আছে। তোমার সহপাঠির ভূমিকা এই ক্ষেত্রে কেমন ছিল তা একটু চিন্তা করো, সে অনুযায়ী পাঁচটি বিকল্পের মধ্যে কোনটির সাথে তার কাজের ধরন বেশি মিলে যায় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নাও। ছক-৩ এর ১.১ কলামে সহপাঠীর রোলনম্বর বরাবর তোমার মতামত, অর্থাৎ 'ক', 'খ', 'গ', "ঘ', 'ঙ' এর মধ্যে যেটা সঠিক মনে হয় সেটি বসাও। একইভাবে দলে বা জোড়ায় কাজে বাকিদের সাথে কেমন কাজ করেছে সেই ব্যাপারে ১.২ ছক থেকে তোমার বিবেচনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নাও এবং ১.২ কলামে রোলনম্বর বরাবর বসাও। ঠিকমত পারবে তো ?
ছক-৩: বিভিন্ন কাজে তোমার সহপাঠীর ভূমিকা সম্পর্কে তোমার মতামত